বিষয় : অথর্ববেদ-এর কুন্তাপ সূক্ত কী প্রক্ষিপ্ত?

কুন্তাপ সূক্ত পাওয়া যায় অথর্ব বেদের শৌনক সংহিতার, ২০.১২৭-১৩৬ অংশে। অথর্ব বেদের পৈপ্পলাদ ও শৌনক শাখার মধ্যে,শৌনক শাখাকেই বিশুদ্ধ হিসেবে ধরা হয়।

(বি.দ্র.যাঁদের কাছে,অক্ষয় লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা অথর্ব বেদ আছে,তাঁরা ২০.৯.৩১দেখবেন)

    প্রথমেই বলে রাখি, কুন্তাপ সূক্ত খিলের অন্তর্ভুক্ত। ‘খিল’ সেই মন্ত্রগুলোকেই বলা হয়, যে মন্ত্রগুলো মূল সংহিতা বা শাখার অর্ন্তভূক্ত নয় কিন্তু পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক আছে তবুও প্রচলিত মত এটাই।

(“কুন্তাপ”, নাম হবার কারণ:)

কুয়ং হ নাম কুৎসিতং ভবতি, তদ্যৎ তপতি তস্মাৎ কুন্তাপাঃ, তৎ কুন্তাপানাং কুন্তাপত্বম্ ।

তপ্যন্তেঽস্মৈ কুয়ানিতি, তপ্তকুয়ঃ স্বর্গে লোকে প্রতিতিষ্ঠতি”

•গোপথ.ব্রাহ্মণ_ ২.৬.১২।

    অর্থাৎ,গোপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী ‘কুয়’ অর্থ কুৎসিত, নিন্দিত, পাপাদি। কিংবা কু দ্বারা কেবল কুৎসিত পাপ-দুর্গুণাদি বা কুম্ দ্বারা পার্থিব – এই সকলকে যে মন্ত্রসমূহ ‘তাপ’ অর্থাৎ সন্তাপিত করে, দূর করে, ভস্মীভূত করে সেগুলোকেই কুন্তাপ বলে।

কুন্তাপ সূক্তের উপর উঠা প্রশ্ন:

    ১.”অথর্ববেদ এর  বিংশ কান্ডের, দশটি কুন্তাপসূক্ত(১২৭-১৩৬), এইগুলো পৈপ্পলাদ শাখায় নেই এবং পদপাঠ পাওয়া যায় না।”

•সূত্র_বৈদিক সাহিত্য,প্রথম খন্ড, অনির্বাণ, পেজ নং ৯৭।

২. স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বিরচিত, “চতুর্বেদ বিষয় সূচী” তে কুন্তাপ সূক্ত প্রক্ষিপ্ত বলে বাদ দেওয়া হয়েছে।

৩.”অথর্ববেদ এর উপসংহারে কুন্তাপ সূক্ত পাওয়া যায়। এই সূক্ত’গুলোর দেবতা, ছন্দ ও বিনিয়োগ নেই এবং পদপাঠ নেই।
সাংকেতিক রহস্যময় খানিকটা আদিরসাত্মক পুনরাবৃত্তিযুক্ত সূক্তগুলি সবই ঋগ্বেদ থেকে উদ্ধৃত। বিতান সূত্রে,সোমযাগে স্তোত্র ও শস্ত্ররূপে এই সূক্তগুলির ব্যবহার পাওয়া যায়।”

•সূত্র_বেদ সংকলন,প্রথম খন্ড, ডঃ উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পেজ নং ২৮

 এইবার কুন্তাপ সূক্ত মৌলিক না প্রক্ষিপ্ত ,এই প্রসঙ্গের বিচার করা যাক:

    বেদাঙ্গের অন্যতম কল্প সূত্রগুলোতে এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কুন্তাপ সূক্তের উল্লেখ আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও অধিকাংশ কল্প হিন্দীতে পাওয়া যায়। তাই সবার মিলিয়ে দেখার সুযোগ নেই।

(কিন্তু আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র বাংলা ভাষায় পাওয়া যায়।)

    তাই আপনাদের সুবিধার জন্য আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের প্রমাণ ও সেইখানে উল্লেখিত,কুন্তাপ সূক্তের অন্তর্গত বিভিন্ন মন্ত্রের যে নাম ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পাওয়া যায়, তার রেফারেন্স সংক্ষেপে দেওয়া হলো:

 

    তস্মাদ্ ঊর্ধ্বং কুন্তাপম্। (আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র_৮.৩.৭) অর্থাৎ,বৃষাকপি সূক্তের পরে এই কুন্তাপ সূক্তের পাঠ হবে।

    (ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উল্লেখিত কুন্তাপ সূক্তের বিভিন্ন মন্ত্রের নাম:)

    ১.নারাশংশী (৩০.৬)। ২.ঐতশপ্রলাপ (৩০.৭)। ৩.প্রবহ্লিকা (৩০.৭)। ৪.আজিজ্ঞাসেন্যা (৩০.৭)। ৫.প্রতিরাধ (৩০.৭)।৬.অতিবাদ (৩০.৭)। ৭.দেবনীথ (৩০.৮-৯)। ৮.ভূতেচ্ছদ্ (৩০.১০)। ৯.আহনস্যা(৩০.১০)।

{গ্ৰন্থসূত্র}

    •আশ্বলায়ন-শ্রৌতসূত্র। •সম্পাদনা_অমরকুমার চট্টোপাধ্যায়। •প্রকাশক_দি এশিয়াটিক সোসাইটি।

    এছাড়াও কুন্তাপ সূক্তের উল্লেখ ও বিনিয়োগ পাওয়া যায়: •শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র_১২.২৩৭। •শাঙ্খায়ন ব্রাহ্মণ_ ৩০.৫। •বৈতান শ্রৌতসূত্র _৬.২.১৬। •গোপথ ব্রাহ্মণ_ ২.৬.১২।

 

উপরে উল্লেখিত ‘কুন্তাপ সূক্তের উপর উঠা প্রশ্ন’, ৩ নং প্রশ্নে ড.উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কুন্তাপ সূক্তকে আদিরসাত্মক বা অশ্লীল বলেছেন!
আসলে এই দোষ বর্তায় বেদের ভাষ্যকারদের উপরে। বেদের প্রাচীন ভাষ্যকারগণ সবাই স্বীকার করেন বেদ ঈশ্বরকৃত কিন্তু ভাষ্য করার সময় মানুষের ইতিহাস, অশ্লীলতা ইত্যাদি খুঁজে পান! এইরকম দ্বিচারিতা করার কারণ আমাদের জানা নেই!

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী

    যে কুন্তাপ সূক্ত প্রক্ষিপ্ত বলেছেন,সেই বিষয়ে কিছু বলা উচিত। দেখুন, আমাদের বৈদিক সাহিত্য বিশাল।সব বিষয় সবসময় মাথায় থাকে না। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মানুষ ছিলেন এবং মানুষ মাত্রেই ভুল হয়।

    তাছাড়া, বেদ মন্ত্রের সাথে সংযুক্ত ঋষি,দেবতার নাম পাওয়া যায় অনুক্রমণী গ্ৰন্থে। যেহেতু কুন্তাপ সূক্তের নির্দিষ্ট ঋষি ও দেবতা নেই তাই দয়ানন্দ সরস্বতী কুন্তাপ সূক্তকে প্রক্ষিপ্ত বলেছেন অথবা অন্য কোন প্রমাণের উপরে ভিত্তি করে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বর্তমান সময়ে তা আর জানার উপায় নেই।

 

(আর্য সমাজের বিদ্বান আচার্য আনন্দপ্রকাশ)

    তাঁর রচিত গ্ৰন্থ ‘অথর্ববেদীয় কুন্তাপসূক্ত (এক বিবেচন)’এ এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তাঁর দেওয়া মতামত ও প্রমাণ অতিসংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো:—

কুন্তাপ সূক্তে মোট, ১৪৭ টি (১৪+১৬+২০+২০+২০+১৬+৬+৬+১৩+১৬) মন্ত্র আছে।

    শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র,বৈতান শ্রৌতসূত্র,আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র,শাঙ্খায়ন ব্রাহ্মণ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও গোপথ ব্রাহ্মণে, এই সূক্তকে কুন্তাপ সূক্ত হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই কুন্তাপ সূক্তের প্রাচীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত।

সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতীত সকলেই কুন্তাপসূক্তকে মূল সংহিতার অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই বিবেচনা করে ।

বেদ ভাষ্যকারদের মধ্যে

     (১) পণ্ডিত জয়দেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার মীমাংসাতীর্থ। (২) পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী। (৩) পণ্ডিত হরিশরণ সিদ্ধান্তালঙ্কার।  তাঁদের অথর্ববেদ ভাষ্যানুবাদে, কুন্তাপসূক্ত মূল সংহিতার অন্তর্গতরূপে স্বীকার করেছেন।

তার মধ্যে,পণ্ডিত ক্ষেমকরণ দাস ত্রিবেদী ও পণ্ডিত জগন্নাথ বেদালঙ্কার কুন্তাপসূক্তের সংস্কৃতভাষ্যও রচনা করেছেন ।

পণ্ডিত বিশ্বনাথ বিদালঙ্কারও সম্পূর্ণ কুন্তাপ সূক্তেরই সুন্দর আধ্যাত্মিক ভাষ্য রচনা করেছেন।

আর্য সমাজ মান্যকারী ভাষ্যকার পণ্ডিত রাজারাম শাস্ত্রী ও পণ্ডিত সাতবলেকর নিজেদের জ্ঞানের নূন্যতার জন্য,কুন্তাপ সূক্ত ১৩৩ ও ১৩৫ ব্যাখ্যা করতে পারেননি।

প্রফেসর রোথ, হিটনী, গ্রিফিট ইত্যাদি পাশ্চাত্য অনুবাদক এই সূক্তকে,নিরর্থক, অশ্লীল(?) ও অসম্বন্ধীয় প্রলাপমাত্র বলেছেন যা সুধী প্রাজ্ঞজনের কাছে উপেক্ষণীয়।

(কুন্তাপ সূক্তের উপরে সন্দেহকারী)

   স্বামী হরিপ্রসাদ বৈদিক মুনি এবং তাঁর সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে গঠিত, পণ্ডিত রঘুনন্দন শর্মার সিদ্ধান্তের খণ্ডন, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনির, ‘বেদমর্যাদা’, মহাত্মা নারায়ণ স্বামীর ‘বেদরহস্য’ এবং পণ্ডিত ব্রহ্মমুনি বিদ্যামার্তণ্ডের, ‘অথর্ববেদ-মুনিভাষ্য-ভূমিকাভাগ’ ইত্যাদি গ্রন্থে খণ্ডন করা হয়েছে।

    {কুন্তাপসূক্ত সম্পর্কে তিনটি ধারণা বিদ্যমান। যথা,দুরূহ, অস্পষ্ট ও প্রক্ষিপ্ত ।}

    দুরূহ ও অস্পষ্টতা বিষয়ে অধিকতর পাশ্চাত্য ও কতিপয় প্রাচ্য বিদ্বানদের যে মতামত তা ভিত্তিহীন এবং তাদের আর্ষগ্রন্থে অনভিজ্ঞতাই মূল কারণ। বেদব্যাখ্যাতার জন্য আর্ষগ্রন্থের স্বাধ্যায়, শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব ও যোগাভ্যাস অত্যাবশ্যক।

প্রক্ষিপ্ত বলার কিছু কারণ পূর্বেই আমরা খণ্ডন করে এসেছি। অনেকেই সায়ণাচার্য পদপাঠ করেননি, এইজন্য একে প্রক্ষিপ্ত দায়ী করেন। এই দাবি অমূলক কেননা সায়ণাচার্য অঘমর্ষণ সূক্তের (ঋগ্বেদ-১০.১৯০) পদপাঠ প্রদান করেননি, অথচ বৈদিকদের সন্ধ্যার নিত্যপাঠ্য মন্ত্রসমুদায়ে এটি বিদ্যমান। তাতে কী এই সূক্ত প্রক্ষিপ্ত ঘোষিত হবে?

 (কিছু পণ্ডিত নামধারী ব্যক্তি)

    অথর্ব বেদের ১৯ ও ২০ কাণ্ড সম্পর্কেও সন্দেহ পোষণ করেন, তাই বলে কি আমাদের শাস্ত্রীয় প্রত্যক্ষ প্রমাণ পরিত্যাগ করে সাধারণ ব্যক্তি মত গ্রহণ করতে হবে?

    আবার ঋগ্বেদীয় খিল হিসেবে প্রসিদ্ধ বালখিল্য সূক্ত, খিল হিসেবে সম্পাদকগণ পরিশিষ্টে ভ্রান্তিপূর্বকস্থান দিলেও সেটিও প্রামাণিক ও মূল সংহিতার অন্তর্গত।

কিন্তু অথর্ববেদে এই ভ্রান্তিরও ন্যূনতম অবকাশ নেই। কেননা, কুন্তাপ সূক্ত অথর্ববেদের সংহিতাপাঠের অন্তর্ভুক্ত তো অবশ্যই,পাশাপাশি এই সূক্তের পরেই সর্বমান্য ও অবিসংবাদিত আরো 7টি সূক্ত (২০.১৩৭-১৪৩) বিদ্যমান। তাই এই সূক্ত প্রক্ষিপ্ত নয় তা প্রমাণিত।

Share this post :

Facebook
Twitter
LinkedIn
Pinterest

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Create a new perspective on life

Your Ads Here (365 x 270 area)
Latest News
Categories

Subscribe our newsletter

Purus ut praesent facilisi dictumst sollicitudin cubilia ridiculus.