পুরাণ কাকে বলে: যুক্তি ও প্রমাণের আলোকে

    প্রশ্ন:- আপনারা বলেন যে,পুরাণ মান্য নয় অথচ অথর্ব বেদ,বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য উপনিষদে পুরাণের উল্লেখ আছে যে!

    উত্তর:- অবশ্যই উল্লেখ আছে।
    কিন্তু পুরাণ মানে বলতে যদি, বর্তমান সময়ে পুরাণ নামে প্রচলিত অশ্লীল, হাস্যকর ও অবৈজ্ঞানিক গ্ৰন্থগুলোকে ভাবেন, তাহলে ধরতে হবে আপনার জ্ঞানের নূন্যতা আছে।

    আপনাদের মান্য গ্ৰন্থ ও মান্য আচার্যদের বক্তব্য থেকেই দেখুন প্রমাণ করছি, পুরাণ কাকে বলে:—————-

                    ব্রাহ্মণানি কল্পান্ গাথা নারাশংসীরিতিহাস পুরাণানীতি (আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ৩.৩.১)

                  ব্রাহ্মণানীতিহাসান্ পুরাণানি কল্পান্ গাথা নারাশাংসীরিতি (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ২.৯.৯)

    অর্থাৎ,ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থের নামই হলো, ইতিহাস,পুরাণ,গাথা, কল্প,নারাশংসী।

                                     তথা পুরাণং তাণ্ডম্। (লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্র ৭.১০.১৭)

                      যে ব্রাহ্মণাক্চ্ছেদাস্তান্ পুরাণাস্তাণ্ডমিত্যুপচর (লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্র ২১.১.৩২)

    উপরের প্রমাণে, সামবেদের কল্প লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্রে,তান্ড্য ব্রাহ্মণ যা কিনা সামবেদের ব্রাহ্মণ,তাকে পুরাণ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

                              পুরাণপোক্তেষু ব্রাহ্মণকল্পেষু। (অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ ৪.৩.১০৫)

    অর্থ প্রাচীন ঋষিদের দ্বারা বর্ণিত বা প্রোক্ত গ্ৰন্থই হলো, ব্রাহ্মণ ও কল্প।

    অর্থাৎ, পাণিনির মতে, পুরাণ শব্দের অর্থ হলো, প্রাচীন। প্রাচীন ঋষিদের লেখা গ্ৰন্থের নামই হলো ব্রাহ্মণ ও কল্প।তাই পুরাণ বলতে ব্রাহ্মণ’কেই বোঝায় কারণ ব্রাহ্মণেরই একটি ভাগ বা নাম হলো, কল্প।

                             ন্যায়সূত্রের ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন, “পাত্রচয়ান্তানুপপত্তেশ্চ ফলাভাবঃ”
                                         (ন্যায়সূত্র _4.1.61), সূত্রের ভাষ্যে বলেছেন যে:–

                        য এব মন্ত্রব্রাহ্মণস্য দ্রষ্টারঃ প্রবক্তারশ্চ তে খল্বিতিহাসপুরাণস্য ধর্মশাস্ত্রস্য চেতি।

    অর্থাৎ,যাঁরা মন্ত্র ও ব্রাহ্মণের দ্রষ্টা এবং প্রবক্তা তাঁরাই ইতিহাস, পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রের প্রবক্তা।

    এর থেকে এইটাই বোঝা যায়,সত্য যুগেও পুরাণ ছিলো, কারণ মন্ত্রের দ্রষ্টা ঋষিগণ ছিলেন সত্যযুগের প্রারম্ভে।তাহলে যেখানে মহর্ষি বেদব্যাস দ্বাপরের শেষের মানুষ সেইখানে তাঁর দ্বারা পুরাণ রচিত হয়েছে, এইটা হাস্যকর ও অযৌক্তিক কথা হয়ে যাচ্ছে না?!

    আদি শঙ্করাচার্য তাঁর বৃহদারণ্যক উপনিষদের (২.৪.১০) ভাষ্য করার সময় পুরাণের উদাহরণ কি দিয়েছেন দেখুন:–

                                            অসদ্বা ইদমগ্ৰ আসীৎ। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২.৭)

    আদি শঙ্করাচার্যের উদাহরণ মানতে কষ্ট হলে, পৌরাণিকদের ধর্ম বাবা প্রসিদ্ধ বেদ ভাষ্যকার আচার্য সায়ণ, তাঁর তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ভাষ্যতে পুরাণ বলতে দেখুন কি বুঝিয়েছেন:–

    আচার্য সায়ণ (তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ২.৯) ভাষ্যতে, “ইতিহাসপুরাণাদি” পদের ব্যাখ্যায় ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থকেই নির্দেশ করেছেন।
    অন্য জায়গায় আবার ইতিহাস বলতে মহাভারত, আর পুরাণ বলতে ব্রাহ্মণ লিখেছেন। এই ধরণের ব্যাখ্যা সায়ণ (তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ৮.২) তেও করেছেন।

    অর্থাৎ, আচার্য সায়ণের মতেও, ব্রাহ্মণ’কেই পুরাণ বলা হয়।

    সুতরাং, পুরাণ বলতে ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থকেই বোঝায়, কদাপি বর্তমান সময়ে পুরাণ নামে প্রচলিত, অশ্লীল গ্ৰন্থগুলোকে নয়।

    প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, মহর্ষি বেদব্যাস পুরাণ’গুলোর রচয়িতা। কিন্তু ত্রেতা যুগের শেষে লিখিত রামায়ণেও পুরাণের প্রসঙ্গ এসেছে, অর্থাৎ পুরাণ অনেক প্রাচীন এবং ব্যাসের বহু পূর্বেও পুরাণের অস্তিত্ব ছিল।

                                                    [এই বিষয়ে প্রমাণ]:—–

               এতদ্ শ্রুত্বা রহঃ সূতো রাজানমিদব্রবীৎ। শ্রূয়তাং তৎ পুরাবৃত্তং পুরাণে চ যথা শ্রুতম্।।১।।

(বাল্মীকি রামায়ণ, আদিকান্ড/বালকান্ড, নবম সর্গ, শ্লোক ১ ) অনুবাদ পঞ্চানন তর্করত্ন। প্রকাশক বেণীমাধব শীল’স লাইব্রেরী।

    অর্থ সেই কথা শুনে সারথি সুমন্ত্র রাজা দশরথ’কে নির্জনে বললেন যে, ঋত্ত্বিকগণ আপনার পুত্র লাভের যে উপায় বার করেছেন,পূর্বে সেই সম্পর্কে পৌরাণিক ইতিহাসে আমি কিছুটা শুনেছি।

ইত্যুক্ত্বান্তঃপুরদ্বারমাজগাম পুরাণবিৎ। সদাসক্তঞ্চ তদ্বেশ্ম সুমন্ত্রঃ প্রবিবেশ হ।।১৮।।

•বাল্মীকি রামায়ণ,
আদিকান্ড/বালকান্ড,
পঞ্চদশ সর্গ, শ্লোক _18।
অনুবাদ _ পঞ্চানন তর্করত্ন।
প্রকাশক _ বেণীমাধব শীল’স লাইব্রেরী।

♣ অর্থ _ এই কথা বলে দশরথের সারথী অতিবৃদ্ধ পুরাণবিদ সুমন্ত্র, অন্তঃপুরের তৃতীয় কক্ষের উন্মুক্ত দ্বারে প্রবেশ করলেন।

•এইখানে দেখুন সুমন্ত্র’কে, ‘পুরাণবিদ’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে।

♦পুরাণের কাজ হলো,বেদের বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করা বিশেষতঃ সৃষ্টি বিদ্যা বিশদভাবে বর্ণনা করা।
এইজন্যই মহাভারত আদি পর্ব’তে(1.267) বলা হয়েছে যে,
পুরাণ ও ইতিহাসের সাহায্য নিয়েই বেদের অর্থ বিচার করতে হবে।

•উপরে বিভিন্ন প্রাচীন গ্ৰন্থ থেকে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে, ইতিহাস ও পুরাণ বলতে ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থ’গুলোকেই বোঝায়। তাই ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থই হলো,বেদের ব্যাখ্যা গ্ৰন্থ।

♣ ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থই যে বেদের ব্যাখ্যা গ্ৰন্থ, এই বিষয়ে প্রমাণ:–

চতুর্বেদবিদ্ধির্ব্রহ্মাভিব্রাহ্মণৈর্মহর্ষিভিঃ প্রোক্তানি য়ানি বেদ ব্যাখ্যানানীতি ব্রাহ্মণানীদি।।

•মহাভাষ্য_5.1.1

♣ অর্থাৎ, চার বেদের জ্ঞাতা ব্রাহ্মণগণ তথা মহর্ষিগণ,বেদের যে ব্যাখ্যা করেছেন; সেই ব্যাখ্যা গ্ৰন্থের নাম হলো,তাঁহা ব্রাহ্মণ গ্রন্থ।

♦ ব্রাহ্মণনাম কর্মণস্তত্মন্ত্রাণাং
চ ব্যাখ্যানগ্রন্থ||

•তৈত্তিরীয় সংহিতা_7.5.7।

♠অর্থাৎ, মন্ত্র সংহিতার ব্যাখ্যা করার জন্য যে গ্রন্থ লেখা হয়েছে,তাই ব্রাহ্মণ গ্রন্থ।

♦ প্রসিদ্ধ বেদ ভাষ্যকার আচার্য সায়ণ, তাঁর শুক্ল যজুর্বেদের কাণ্ব শাখার ভাষ্যে লিখেছেন:—-

“তত্র শতপথব্রাহ্মণস্য মন্ত্রব্যাখ্যানরূপত্বাৎ।”

•কাণ্ব সংহিতা, সায়ণ ভাষ্য, পৃষ্ঠা_ 8।

♠অর্থাৎ, শতপথ আদি ব্রাহ্মণ গ্রন্থ হলো, মন্ত্রের ব্যাখ্যান রূপ।

♦ ভট্টভাস্করও প্রায় একই কথা লিখেছেন:–

“ব্রাহ্মণং নাম কর্মণস্তন্মন্ত্রাণাং চ ব্যাখ্যানগ্রন্থঃ”

•ভট্টভাস্কর,
তৈত্তিরীয় সংহিতা ভাষ্য_ 1.5.1।

♦ নিরুক্তের টীকাকার এবং ঋগ্বেদের উপলব্ধ প্রাচীন ভাষ্যকার আচার্য স্কন্দস্বামীও, ব্রাহ্মণকে বেদের অর্থ বিবরণকারী গ্রন্থ মান্য করেছেন:–

“শতপথব্রাহ্মণে বিবরণাৎ” তথা “শতপথে-অর্থবিবরণ-প্রদর্শনাৎ।”

•স্কন্দস্বামী,
ঋগ্বেদ ভাষ্য_ 1.30.10 ও 1.32.3।

♦বেদাঙ্গের অন্যতম গ্ৰন্থ নিরুক্তের কিছু স্থানে নিরুক্তকার যাস্ক,

“ইতি ব্রাহ্মণম্ বিজ্ঞায়তে”
আদি শব্দ ব্যবহার করে নিজের দেওয়া অর্থের প্রমাণ,ব্রাহ্মণ বাক্য দ্বারা দেখিয়েছেন।

(নিরুক্ত 3.20,12.8, 6.31,10.5)

♦ সুতরাং,ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থগুলোই হলো,বেদের ব্যাখ্যা গ্ৰন্থ এবং তাই ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থগুলোই হলো পুরাণ।
বর্তমান সময়ে পুরাণ নামে প্রচলিত অশ্লীল গ্ৰন্থগুলো, কদাপি পুরাণ নয়।

Share this post :

Facebook
Twitter
LinkedIn
Pinterest

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Create a new perspective on life

Your Ads Here (365 x 270 area)
Latest News
Categories

Subscribe our newsletter

Purus ut praesent facilisi dictumst sollicitudin cubilia ridiculus.