উপনিষদের প্রভাব

আমাদের জীবনে উপনিষদ-সমূহের প্রভাব
ড. সুরেন্দ্র কুমার
প্রাক্তন উপাচার্য, গুরুকুল কাংড়ী বিশ্ববিদ্যালয়, হরিদ্বার এবং বিশুদ্ধ মনুস্মৃতির ভাষ্যকার।
    এই নশ্বর পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে বুদ্ধি জাগ্রত হওয়ার পর, বহু মানুষের মনেই এরূপ জিজ্ঞাসা আসে যে, আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? জীবন সমাপ্তির পর কোথায় যাব? সারাজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত ধনসম্পদের মধ্যে আমার সাথে কোনগুলো যাবে? আর কোনগুলো যাবে না? সুখ ও দুঃখ মিশ্রিত এ সংসারে দুঃখ কীভাবে দূর করবো আর সুখ কীভাবে পাব? জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে কীভাবে মুক্তি পাব?” এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর না পাওয়া অব্দি জিজ্ঞাসুগণ মানসিক সন্তুষ্টি পান না।
উপনিষদ্ জীবন-বিষয়ক এ সকল স্বাভাবিক প্রশ্নের সঠিক উত্তর। এই উত্তরগুলো আমাদের প্রাচীন বৈদিক ঋষিগণ সেই বৈদিক যুগেই খুঁজে নিয়েছিলেন। আর সেসব প্রশ্নের উত্তরগুলো তাঁরা জন-কল্যাণের জন্য উপনিষদ্‌ প্রস্তুত করেছেন। উপনিষদ্‌ ভৌতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়। আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের জন্য এটি যেমন উপযুক্ত, সাংসারিক ব্যক্তিদের জন্যেও তেমনি উপযুক্ত, কেননা উপনিষদ্ আমাদের সুখ শান্তিপূর্বক সাংসারিক জীবনযাপনের পদ্ধতি শেখায়। পাশাপাশি আত্মিক শান্তিদায়ী আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়ে অধ্যাত্মমুখী করে অমরত্বের দিকে ধাবিত করে। উপনিষদ্‌ যতটা প্রাসঙ্গিক তখন ছিল, ততটাই প্রাসঙ্গিক এটি আজও আছে এবং ততদিন থাকবে যতদিন উপনিষদের অস্তিত্ব আছে। বরং দুঃখ, প্রতিস্পর্ধা ও অবসাদের এই ভৌতিকপ্রধান যুগে মানসিক শান্তির জন্য এর আবশ্যকতা আরো বেশি। এ কথা পাঠকেরা ভালোভাবে জানেন।
    মুখ্য উপনিষদসমূহ প্রস্তুত হওয়ার পর যখন মানুষদের কাছে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে, তখন কিছু ধূর্ত লেখকেরা উপনিষদের নামে অনেক অবৈদিক উপনিষদ্ রচনা করে গিয়েছেন। এরকম রচনার সংখ্যা প্রায় ২৪০-এর কাছাকাছি। কিন্তু মুখ্য উপনিষদ্ এগারোটিই। এগুলো যথাক্রমে- ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুশুক, মাণ্ডুক্য, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, বৃহদারণ্যক, ছান্দোগ্য ও শ্বেতাশ্বতর। এ সকল উপনিষদই বেদমূলক। উপনিষদসমূহের মধ্যে সবার প্রথমে যাকে স্থান দেওয়া হয় এবং সর্বপ্রমুখ যে উপনিষদকে বলা হয় তার নাম ঈশোপনিষদ, যা মূলত যজুর্বেদের চল্লিশতম অধ্যায়ের মন্ত্রসমূহের সংকলন। তাতে জীবনের লক্ষ্য, নশ্বর ভৌতিক জগতে বেঁচে থাকার উপায় ইত্যাদি বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে-ভূমিকা
ঈশা বাস্যমিদং সর্বং য়ৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্। (মন্ত্র ১)
    অর্থাৎ ঈশ্বর এই সমস্ত জগতে এবং জগতে বিদ্যমান প্রতিটি পদার্থেই তিনি অধিষ্ঠান করে আছেন এবং এ সমস্ত কিছুর অধিপতি তিনি। অতএব ঈশ্বরকে নিজের প্রভু মেনে তাঁর দেওয়া পদার্থসমূহকে ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে ভোগ করো এবং অন্য কারোও ধনের প্রতি লোভ কোরো না। অথবা, মা গৃধঃ = লোভ কোরো না, কস্যম্বিদ ধনম্ জগতের ধনসমূহ কার? কার সাথে এই ধন যাবে? কারো সাথেও না। এই সমস্ত ধন এখানেই থাকবে। এই সবকিছু ঈশ্বরের এবং তাঁর অধীনেই সবকিছু থাকবে। এই বেদমন্ত্রে তিনটি সত্ত্বার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাকে বৈদিক দর্শনে ত্রৈতবাদের সিদ্ধান্ত বলা হয়। সেগুলো যথাক্রমে- জগতের স্বামী ঈশ্বর, প্রকৃতি দ্বারা নির্মিত জগৎ এবং ঈশ্বর দ্বারা নির্মিত জগতের ভোক্তা জীবাত্মা। এই তিন তত্ত্বেরই আলংকারিক ব্যাখা মুণ্ডক উপনিষদে প্রকৃতিরূপী বৃক্ষে বসে থাকা দুটি পাখির মাধ্যমে করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি জীবাত্মা, যিনি ফল ভোগকারী এবং দ্বিতীয়টি পরমাত্মা, যিনি সেই জীবাত্মার কর্মের দ্রষ্টা এবং সে অনুসারে ফল প্রদান করেন (মুণ্ডক০ ৩।১।১, শ্বেতা০ ৪।৬)। ঈশোপনিষদের উক্ত প্রথম মন্ত্রের পর পঠিত সব মন্ত্রের সাথে পরস্পরের সঙ্গতি আছে। অতএব, সেসব মন্ত্রে বর্ণিত তিন তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই সকল মন্ত্রের অর্থ করা উচিত। পরে বলা হয়েছে সেই ঈশ্বরের স্বরূপ কী? সম্পূর্ণ জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুতে বিরাজমান থাকায় তিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ, নিরাকার, দেহহীন, শিরা ও স্নায়ুর বন্ধন থেকে মুক্ত, শুদ্ধ, পাপহীন, অনাদি (মন্ত্র ৮)। সেই পরমাত্মায় আস্থা রেখে জীবাত্মার নির্লিপ্তভাবে কর্ম করার মাধ্যমে শত বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছা রাখা উচিত (মন্ত্র ২)। জগতের নশ্বরতাকে সত্য এবং পরমাত্মাকে অবিনশ্বর সত্যস্বরূপ জেনে জীবাত্মা জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে অমৃত তথা মোক্ষসুখ লাভ করতে পারে (মন্ত্র ১৪)। নশ্বর এই শরীরের অন্তিম পরিণাম দাহকর্ম দ্বারা ভস্ম হয়ে যায় (মন্ত্র ১৫)। একই পরিণাম নশ্বর ভৌতিক জগৎ এবং জাগতিক সম্পদের হয়ে থাকে।
    বেদ এবং উপনিষদাদি শাস্ত্রসমূহ ভৌতিক পদার্থ ও সম্পত্তি লাভ করাকে নিষেধ করছে না। বৈদিক সংস্কৃতিতে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চারটিকে পুরুষার্থরূপে স্বীকার করা হয়েছে। ভৌতিক জীবনযাপনের জন্য ভৌতিক সাধন-সুবিধা অপরিহার্য। তাই তো বেদ বলে- “বয়ং স্যাম পতয়ো রয়ীণাম্” (ঋ০ ১০।১২১।১০) অর্থাৎ আমরা যেন সম্পদ ও ঐশ্বর্যের স্বামী হতে পারি। কিন্তু বেদ এটিও বলে যে, ধনাদি ভৌতিক বস্তুর প্রতি আসক্ত হওয়া উচিত নয়। এদের সাধন হিসেবে জেনে ব্যবহার করা উচিত, সাধ্য হিসেবে নয়। এদের ব্যবহার এভাবে করুন যেমন কোন কার্যালয়ে কর্তব্যরত কোন ব্যক্তি বাহন দ্বারা তার কর্মক্ষেত্রে গমন করে, কর্ম দ্বারা উপার্জনও করে, কিন্তু মোহরহিত হয়ে তাদেরকে ছেড়ে ঠিকই আবার বাড়ি ফিরে আসে। বাহনের প্রতি মমত্বে লিপ্ত হয় না। মমত্বে লিপ্ত হওয়ার পরিণামই আসক্তি এবং আসক্তিতে লিপ্ত হওয়ার পরিণামই দুঃখ। আরেকটি কারণ হলো এই যে, ধনাদি ভৌতিক পদার্থ দ্বারা আত্মিক শান্তি পাওয়া যায় না। এই আত্মিক সুখ পাওয়া যায় শুধু অধ্যাত্ম দ্বারা। সুতরাং সুখী জীবনযাপনের উপায় হচ্ছে ধনাদি ভৌতিক পদার্থকে ত্যাগের মনোভাব এবং ভৌতিক বিষয়ের প্রতি আবেগপ্রবণ বা আসক্ত না হওয়ার মাধ্যমে ব্যবহার করা।
    উপরে যেমন বলা হয়েছে, সমস্ত উপনিষদের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে শারীরিক সুখ ও শান্তির ঊর্ধ্বে ওঠে অমরত্ব ও আধ্যাত্মিক সুখ অর্জন করতে শেখানো। কঠোপনিষদে নচিকেতা ভৌতিক পদার্থে সন্তুষ্ট ছিলেন না। চিন্তা করার পর তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন- “ন বিত্তেন তর্পণীয়ো মনুষ্যঃ” (কঠ০ ১।২।২৭) অর্থাৎ জীব অর্থের মতো বস্তুগত জিনিসে কখনো সন্তুষ্ট হয় না। তাই জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মৃত্যুকে জয় করার জ্ঞান প্রাপ্ত করতে সে যমাচার্যের নিকট যান। যমাচার্য তখন স্বর্গলোকের মহিমা বর্ণনা করে পার্থিব কামনা-বাসনা ত্যাগ করে ব্রহ্মবিদ্যার জ্ঞান ও তা অর্জনের উপায় বলেন। যমাচার্য বলেন যে, “মর্ত্যো অমৃতো ভবতি” (কঠ০ ২।৩।১৫) অর্থাৎ অন্তঃকরণের কামনারূপী সকল গ্রন্থি যখন উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন এই মরনধর্মা জীব মুক্ত হয়ে যান।
    বৃহদারণ্যক উপনিষদে একটি বর্ণনা আছে যে, ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য যখন গৃহত্যাগ করেন তখন তিনি তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে বলেছিলেন যে, “এসো, তোমার সম্পদ বণ্টন করে দিই।” ভৌতিক পদার্থ এবং আত্মবিদ্যার পার্থক্য জানা মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসা করলেন- “ইয়ং ভগঃ সর্বা পৃথিবী বিত্তেন পূর্ণা স্যাৎ কথং তেন অমৃতা স্যাম” (বৃহদা০ ২।৪।২)। অর্থাৎ “ভগবন্! যদি আমি এই সমগ্র পৃথিবীকেই ধনধান্যে পূর্ণাবস্থায় পেয়ে যাই, তবে কি আমি অমর হয়ে যাবো?” উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বললেন- “অমৃতত্বস্য তুন আশা অস্তি বিত্তেন” অর্থাৎ ধন-সম্পদ থেকে অমরত্ব লাভের আশা করা যায় না। অর্থ কেবল একটি সুবিধাজনক জীবনযাপনের একটি উপায়। অমরত্ব লাভের উপায় একমাত্র ব্রহ্মলাভ। আর সে ব্রহ্মকে লাভ করার সমস্ত উপায়ই উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে। উপনিষদের বিশেষত্ব এই যে, পরমাত্ম ও আত্ম-তত্ত্ব ব্যাখ্যার পাশাপাশি জীবন ও তার মৌলিক স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর, মন, মস্তিষ্ক, হৃদয়, পঞ্চকোষ, ইন্দ্রিয় ইত্যাদির মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়। যাতে ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রক্রিয়া, পরিণাম, বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষের সঠিক জ্ঞান থাকতে পারে।
    মানুষকে ভালো আচার-ব্যবহারে গড়ে তোলাও উপনিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। কেননা, সদাচরণ ব্যতীত একজন মানুষ সদাচারী হতে পারে না এবং তার সদাচরণ ব্যতীত পরিবার, সমাজ ও জাতি সদাচারী হতে পারে না, আদর্শবান হতে পারে না। তাদের মধ্যে অপরাধশূন্যতা এবং সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। উপনিষদ্ হলো বৈদিক যুগের সংস্কৃতি, সভ্যতা ও ইতিহাসের দর্পণ। আদর্শ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতি এবং বৈদিক যুগের আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনাও উপনিষদে পাওয়া যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আদর্শ রাজ্যের নিম্নলিখিত ঘোষনা উপনিষদের উপদেশ পালনকারী কেকয়-নরেশ ‘অশ্বপতি’ এর মতো কোনো রাজাই করতে পারেন-
নমে স্তেনো জনপদে ন কদর্যো ন মদ্দপঃ।
নানাহিতাগ্নির্নাবিদ্দান্ ন স্বৈরী স্বৈরিণী কুতঃ। (ছান্দোগ্য০ ৫।১১/৫)
অর্থাৎ “আমার রাজ্যে কেউ চোর নেই, কৃপণ নেই, মাতাল নেই, প্রতিদিন যজ্ঞ করেন না এমন কেউ নেই, কোন অবিদ্বান নেই, ব্যভিচারী নেই এবং ব্যভিচারিণী নারীও নেই।” বেদ, উপনিষদের মতো আধ্যাত্মিক গ্রন্থেই সংস্কার নির্মাণের সেই শক্তি আছে যে, রাজা অশ্বপতির মতো একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীর কোনো রাজা বা শাসক কি মহারাজ অশ্বপতির মতো এমন সুশাসন দাবি করতে পারেন?
    জীবনে উপনিষদের উপযোগিতা অনুভব করে এখন পর্যন্ত শত শত দেশি-বিদেশি লেখক সেগুলোর অনুবাদ অথবা ভাষ্য করেছেন। উপনিষদের গুরুত্ব বোঝাতে এখানে মাত্র দুজন বিদেশি ব্যক্তির মতামত উদ্ধৃত করছি। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের বড় ছেলে এবং আওরঙ্গজেবের ভাই দারাশিকোহ্ উপনিষদ্ অধ্যয়নের পর এতটাই আধ্যাত্মিক শান্তি অনুভব করেছিলেন যে, তিনি সেগুলোকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন যদিও সেগুলো তার ধর্মগ্রন্থ ছিল না। তিনি তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন- “উপনিষদ্‌ অধ্যয়ন আত্মায় শাশ্বত শান্তি ও আনন্দ উৎপন্ন করে।” জার্মান পণ্ডিত শোপেনহাওয়ার লিখেছেন- “জীবনে যদি কোনো কিছু থেকে আমি আত্মিক শান্তি পেয়ে থাকি, তা হলো উপনিষদ্ এবং যদি মৃত্যুর সময় কিছু থেকে আমি শান্তি পেতে পারি, তাও উপনিষদ থেকে।” উপনিষদের মহত্ত্ব প্রদর্শন করতে এর চেয়ে নির্ভুল ও আনন্দদায়ক মন্তব্য আর কী হতে পারে? এভাবে আমরাও যদি উপনিষদের বাণীসমূহ নিজেদের হৃদয়ে ধারণ করতে সক্ষম হই, তাহলে এর মাহাত্ম্য আমরা অনুভব করতে সক্ষম হব।

Share this post :

Facebook
Twitter
LinkedIn
Pinterest

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Create a new perspective on life

Your Ads Here (365 x 270 area)
Latest News
Categories

Subscribe our newsletter

Purus ut praesent facilisi dictumst sollicitudin cubilia ridiculus.